Size / / /

ঢাকা শহরের প্রবীণ অধিবাসীরা স্মরণ করতে পারে যে, বহুদিন পূর্বে ঢাকা শহর একবার কাকশূন্য হয়ে পড়ে, তখন এই ঘটনা অথবা ঘটনাবলি পাঁচ বৎসর ধরে সংঘটিত হয় এবং এর সূচনা হয় বৈকুণ্ঠপুর নামক এক গ্রামে। যমুনা নদীর পশ্চিম পারে সিরাজগঞ্জ শহরের এবং সিরাজগঞ্জ শহরের ছয় মাইল পশ্চিমে একটি ছোট্ট গ্রাম, সেই গ্রামের নাম বৈকুণ্ঠপুর। বৈকুণ্ঠপুরের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত ঘেঁষে বয়ে গেছে একটি খাল, শুকনোর দিনে গাঁয়ের ছেলেরা এখানে ফুটবল খেলে, বর্ষার সময় পানি কোমরসমান হলে কলার ভেলায় করে লোকজন পারাপার হয়। এই খালের পাড় থেকে পঞ্চাশ হাতের ভেতর গাছপালায় ঘেরা এক পোড়ো ভিটায় ঝুপড়ি বেঁধে বাস করে এক কাঠুরে, তার নাম আকালু, তার একটিই নাম এবং তার সঙ্গে থাকে তার স্ত্রী টেপি, টেপিরও নাম একটিই। আকালু ভূমিহীন গরিব লোক, টেপির বাপও ভূমিহীন ছিল; তারা যে ভিটেয় ঘর বেঁধে বাস করে সেটা গ্রামের মিয়াদের সম্পত্তি, তারা শুধু অনুমতি নিয়ে থাকে। ভিটেয় তাদের একটি থাকার ঘর আর একটি রান্না করার চালা, পায়খানা নাই; এ প্রয়োজনে তারা ভিটের পূর্বধারে ঘন বাঁশঝাড় ব্যবহার করে। আকালু ও টেপি দুজনেই কালো এবং দুজনেরই স্বাস্থ্য খারাপ, কিন্তু তাদের দুজনেরই জীবনে তখন যৌবন এবং দুজনে খুব ভাব। আকালুর মনে হয় যে, তার বউটি মন্দ না, কেবল মাথায় একটু ছিট আছে; একা একা বিড়বিড় করে কথা বলে আর রাতে ঘুমানোর পর দাঁত কটকট করে। এজন্য আকালু নানা রকম তাবিজ জোগাড় করে টেপির শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ঝুলিয়ে দেয়; কতগুলো তাবিজ একা একা কথা বলা বন্ধ করার জন্য টেপির গলায় ঝুলে আছে, দুহাতের বাজুতে বাঁধা দুটো চৌকোনা তাবিজ রাতে দাঁতের খটখটি বন্ধ করার জন্য; আর একটি তাবিজ, যেটা দেখা যায় না, আছে টেপির কোমরে, যাতে সে তাড়াতাড়ি সন্তান ধারণ করে। কিন্তু টেপির গর্ভে সন্তান আটকায় না এবং সে একা একা কথা বলতেই থাকে। তখন আষাঢ়ের শেষে অথবা শ্রাবণের প্রথমে একদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙলে আকালু ঠিক করে যে, সে সেদিন কাজের খোঁজে বেরোবে না, সারা দিন বউকে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকবে এবং সে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর যখন রোদ এসে শোলার বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঝুপড়ির ভেতর ঢুকে পড়তে থাকে তখন সে আবার জেগে ওঠে এবং ঘরের পেছনে নরম একটি আওয়াজ শোনে; টেপি আলতো পায়ে হেঁটে বেড়ায়, বিড়বিড় করে ও সোনামানিক, আহা রে তক পোকা ধইরছে, খাড়া ছাই নিয়া আইসত্যাছি; টেপি যখন চুলোর ছাই নিতে আসে আকালু ডাক দেয়, টেপি। কী হইছে তর, সোনামানিক কেডা?

টেপির তখন সংবিত ফিরে আসে, সে হাসে এবং বলে, আইসা দেখো।

আকালু উঠে আসে, টেপি তাকে নিয়ে গিয়ে দেখায় জাংলায় লতিয়ে ওঠা শসা গাছে কচি জালি এসেছে এবং হাতের কড়ে আঙুলের মতো চিকন জালি শসার মাথায় সাদা ফুল। আকালু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, টেপি পোকা খুঁজে বের করে মারে, গাছের পাতায় ছাই ছিটিয়ে দেয়। তখন গাছপালার উপর দিয়ে দুটো দাঁড়কাক উড়ে আসে, একটি খানিকটা দূরে আমগাছের ডালে গিয়ে বসে, অন্যটি এসে বসে তাদের ছনের ঘরের মাথায়; তারপর তারা কাওয়া কাওয়া করে ডাকতে থাকে, টেপির মনোযোগ তখন শসা থেকে কাকের দিকে যায়।

এই গেরামের মইদ্দে এত বড় কাউয়া আইসলো কইন থেইকা?

আকালু ভেবে দেখে এবং বলে, সিরাজগঞ্জ থেইক্যা আইছে মনে হয়, তর বাড়িত আইজ দাওয়াত খাইব।

আকালুর কথায় টেপি খুব মজা পায়, সে কাকের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে, আহা রে, তাই? অতদূর থেইক্যা উইড়্যা আইছিস? খুব খিদ্যা নাইগছে? পানি খাবি? খাড়া।

টেপি মাটির হাঁড়িতে করে পানি এনে উঠোনের একধারে রেখে অন্য ধারে সরে গিয়ে বলে, নে, খা।

কিন্তু কাকেরা পানি খেতে নেমে আসে না, তারা কাওয়া কাওয়া করতে থাকে, তাতে টেপি বিরক্ত হয়ে পড়ে; বলে কী কইস? ভাগ, দূর হ ; সে ঢিল ছুড়ে মারার ভান করলে ঘরের টুয়ায় বসা কাকটি উড়ে গিয়ে আমগাছের ডালে অন্য কাকটির নিকটে বসে। টেপি তখন কাকদের ছেড়ে অন্যদিকে যায়, আকালু এসে ঝুপড়ির দরজায় বসে এবং তখন ঝোপ-জঙ্গলের পথ বেয়ে পাঙ্গাসিহাটের জব্বার আলি এসে হাজির হয় ; সে আকালুকে বলে যে, সিরাজগঞ্জ শহরের যে ঠিকাদার হাইস্কুলের বড় বটগাছটি কিনেছে সে একজন কাঠুরে খুঁজছে। কিন্তু আকালু বলে যে, তার যেতে ইচ্ছে করে না, সে আজকে টেপির সঙ্গে গাছ আর ঝোপঝাড়ের ভেতর হেঁটে বেড়াবে।

টেপির তখন আবার খেয়াল যায় কাকদের দিকে, সে বলে, কী কইস তরা, অ্যা?

কাকেরা কাওয়া কাওয়া করে, টেপি বলে, ইআল্লা, কয় কি - কাটুকগা, কাটুকগা; এই কথা বলে টেপি ঘর থেকে কুড়াল বের করে আনে। আকালু যেতে চায় না, কিন্তু টেপি তাকে জোর করে পাঠায়। পাঙ্গাসি হাইস্কুলের খেলার মাঠের এক পাশে জন্মানো,  এক শ বছর পুরোনো বটগাছ সিরাজগঞ্জ শহরের কোনো এক ঠিকাদার ইতিমধ্যে কেটে চেরাই করে সরিয়ে ফেলেছে, আকালুকে নিয়ে ঠিকাদারের লোক যখন গাছের কাছে যায় তখন সে দেখে যে মাঠের ভেতর কেবলমাত্র আটটি বড় বড় গিঁট এবং মাটির তলার কন্দ পড়ে রয়েছে।

এইগুলান ফাইড়্যা চুলার খড়ি বানায়া দিব্যা।

পঞ্চাইশ ট্যাহা নাইগব।

ধুহ্, পাগল, পঞ্চাইশ ট্যাহার খড়িই নাই; দশ ট্যাহা পাবি।

আকালু রাজি হয় না, শেষে বিশ টাকায় রফা হয় এবং এই কাঠ কাটতে গিয়ে সে বুঝতে পারে যে, তার ঠকা হয়ে গেছে। গাছের গিঁট সহজে চেরাই করা যায় না, তিন দিন সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত পরিশ্রম করে সে সাতটি টুকরো কাটতে পারে; তার খুব মন খারাপ হতে থাকে এই ভেবে যে, টেপি তাকে জোর করে এই কাজে পাঠিয়েছে। চতুর্থ দিন সকালে আকালু একা একা গাছের শেষ গিঁটটা কাটতে শুরু করে এবং তখন আকাশে মেঘ করে বৃষ্টি নামে। কিন্তু আকালু তার কাজ থামায় না, সে গিঁটটার তিন দিক থেকে পরতের পর পরত কেটে নামায়, গাছের এই খণ্ডটি আস্তে আস্তে অর্ধগোলাকার এবং ছোট হয়ে আসে। তখন বৃষ্টির ওপর হঠাৎ খেপে উঠে আকালু কুড়াল চালায়, তার গলার ভেতর থেকে ঘড়ঘড় শব্দ উঠে আসে এবং তার কুড়ালের ফলা ছোট এবং গোলাকার হয়ে আসা গিঁটটার ভেতর ঢুকে যায়। আকালু বুঝতে পারে, গিঁটটার ভেতর একটি ফোকর আছে, তারপর আর কিছু না ভেবে আরো খানিকটা কাটলে ফোকরের ভেতর সে খাকি রঙের একটি কাপড় দেখতে পায়। তখন সে সচেতন হয় এবং খুঁজে দেখে যে, গিঁটের যে দিকটা মাটির সঙ্গে লেগেছিল সে দিকটায় ফোকরের একটি মুখ আছে, মুখটা মাটি দিয়ে বোজানো। কুড়াল দিয়ে ফোকরের মুখের মাটি সরিয়ে সে ভেতর থেকে ছোট বাচ্চাদের কোলবালিশের আকারের একটি পেট মোটা কাপড়ের ব্যাগ টেনে বের করে এবং প্রবল বর্ষণের ভেতর ব্যাগটা গামছা দিয়ে জড়িয়ে সন্তর্পণে তার ঘরের দরজায় এসে টেপিকে ডাকে।

ধর।

কী?

জানি না, চুপ, একদম কথা কবি না।

তারপর তারা কাপড়ের ব্যাগের মুখ খুলে ভেতর থেকে পলিথিনের একটি ব্যাগ বের করে দেখতে পায় যে, ব্যাগ ভর্তি কাগজের টাকা। আকালু পলিথিনের মুখ খুলে মাটিতে চাটাইয়ের বিছানার উপর ঢেলে দিলে টেপি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়।

ট্যাহা না? এত ট্যাহা কোনে পাইলা?

গাছের খোড়লের মইদ্দে।

আল্লা এইর নেইগা কাউয়া কইছিল, কাটুকগা; কী ভালো না কাউয়াগুলান?

হেঁ।

আর-এক দিন আইসলে অগোরে পায়েস রাইন্দ্যা খাওয়ামু।

খাওয়াইস।

আকালু গুণে দেখে এক শ টাকা নোটের দশটি তাড়া, টেপি বলে, কত ট্যাহা এইখানে? আকালু হিসাব করতে থাকে, কিন্তু এই হিসাব সে শেষ করতে পারে না, বলে, এক শ ট্যাহার নোট এইগুলান, এক বান্ডিলে আছে একশ খান, আর বান্ডিল হইলো দশ খান।

কত ট্যাহা হয়?

আকালু বলে, অনেক।

তারা তখন টাকাগুলো আগের মতো ব্যাগে ভরে ঘরের মেঝে খুঁড়ে পুঁতে রাখে, এবং রাতে চাটাই আর কাঁথার উপর শুয়ে আকালুর থুতনিতে নাক ঘষে টেপি কথা বলে। তারা প্রথমে টাকাটা কোত্থেকে এল তা অনুমান করার চেষ্টা করে এবং নিশ্চিত হয় যে, এগুলো ডাকাতের রেখে যাওয়া টাকা, তারপর তারা এই টাকার সম্ভাব্য ব্যবহার নিয়ে ভাবে। টেপি বলে, এই ভিট্যাখান কিনা ফালাও, কিন্তু আকালু বলে যে, এই টাকা বের করলে বিপদ আছে; তখন তাদের দুশ্চিন্তা হয় এবং আকালু টেপির শরীর জড়িয়ে ধরে বলে, কাইলই সিরাজগঞ্জ যায়া উহিলের নগে কথা কয়া আসমুনি।

পরদিন সকালে টেপির দেয়া চিড়া এবং গুড় গামছায় বেঁধে আকালু সিরাজগঞ্জ শহরে আদালতের সামনে গিয়ে হাজির হয় এবং একজন পান-সিগারেট বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা ভাই, এইখানে কোনো উহিলটুহিল পাওয়া যাইব না?

হুঁ, কত উহিল শহরে, তোমার উহিল দিয়্যা কী কাম?

এই ইট্টু বুদ্দি নিমু।

কী বুদ্দি?

না এই এমনি; ধরেন আপনে যুদি এহন এই রাস্তায় এক শ ট্যাহা কুড়ায়া পান, এই ট্যাহা কি আপনের? আপনি কি খরচ কইরবার পারেন এই ট্যাহা?

আকালুর কথা শুনে মফস্বল শহরের এই সিগারেট বিক্রেতার মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়।

তুমি ট্যাহা পাইছ?

না, এমনি কইত্যাছি।

কত পাইছ?

আকালু বলে, দুই শ ট্যাহা।

ধুহ, ব্যাটা চাষা, তুই মিছা কথা কইস!

না, না, আসলে এক হাজার ট্যাহা পাইছি, এহন এট্টু উহিলের বুদ্দি নাগে।

উহিলের কাছে তোমাক নিয়া যামুনি; কিন্তু আমাক ট্যাহার ভাগ দেওয়া নাইগব।

দিমু, আকালু বলে।

আদ্ধেক দিব্যা আমাক।

আচ্ছা দিমু।

সিগারেট বিক্রেতা শহরের পূর্বদিকে মমতাজ সিনেমা হলের পেছনে আকালুকে নিয়ে এক উকিলের বাসায় যায়। উকিল সাহেব তখন কালো কোট পরে, পেট-মোটা একটি ব্যাগ বগলদাবা করে বের হচ্ছিল; তখন তারা গিয়ে হাজির হয় এবং সিগারেট বিক্রেতা বলে, ছার, আপনের কাছে আইসলাম, আমার মামাতো ভাইয়ের একখান বুদ্দি নাগে।

উকিল সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকান এবং বলেন, বুদ্ধি নাইগলে পয়সাও নাগে, তা জানো?

জি, পয়সা আছে, আকালু বলে।

কত আছে?

বিশ ট্যাহা।

কিন্তু আমার রেট ত্রিশ ট্যাহা।

তখন সিগারেট বিক্রেতা অবশিষ্ট দশ টাকা দিতে সম্মত হয় এবং তারা উকিলের চেম্বারে ঢুকে বসে। আকালু যখন বুঝিয়ে বলে, কেন তার বুদ্ধি দরকার, তার কথা শুনে উকিল সাহেবের আক্কেলগুড়ম হয়ে যায়।

কত ট্যাহা পাইছ?

এক হাজার; নাকি, হেঁ এক হাজারই।

ধুহ্, ব্যাটা ডাকাইত, তুমি মিছা কথা কও।

না, আসলে পাইছি এক শ ট্যাহার নোট।

উকিলের চোখ ঝকমক করে, সে বলে, এক শ ট্যাহার নোট বান্ডিলে কয়খান?

একশ খান।

বান্ডিল কয়খান?

আকালু প্রথমে বলে, দুই খান; তারপর বলে, না পাঁচখান।

হুম, উকিল সাহেব ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে উঠে গিয়ে ঘরের দরজা লাগিয়ে দেয় এবং বলে ত্রিশ টাকায় এই বুদ্ধি হয় না।

তা হইলে?

আমাক অর্ধেক দিবা।

আচ্ছা দিমু, আকালু বলে।

তাইলে, আদ্ধেকের আদ্ধেক আমাক দিবা, সিগারেট বিক্রেতা বলে।

আচ্ছা দিমু।

তাইলে চলো এখন তোমার বাড়িত যাই, উকিল বলে, আগে টাকা দেও পরে বুদ্ধি দিমু। তারা তিন জন দুপুরের সময় বৈকুণ্ঠপুরে আকালুর ভিটেয় এসে ওঠে। টেপি বাড়ি ছিল না, আকালু টাকা বের করার পর উকিল সাহেব বান্ডিল গুণে দাঁত বের করে হাসে, তারপর পাঁচটা বান্ডিল নিজে রেখে অন্য পাঁচটা বান্ডিল আকালুকে ফিরিয়ে দেয়। সিগারেট বিক্রেতা লোকটা আকালুর হাত থেকে তিনটি বান্ডিল নিয়ে নেয়, তখন আকালুর হাতের অবশিষ্ট দুটো বান্ডিলের দিকে তাকিয়ে উকিল সাহেব বলে, এই টাকা এক বছরের আগে বাইর কইরো না, তোমাক এই বুদ্দি দিলাম; এক বছর পর অল্প অল্প কইরা বাইর কইরা খরচ কইরো, বেশি টাকা তোমার হাতে দেইখলেই মাইনষের সন্দেহ হইব আর তোমাক ধইরা জেলে ঢুকাইব।

উকিল এবং সিগারেট বিক্রেতা চলে যাওয়ার পর টেপি ফেরে এবং আকালুর কাছে সব শুনে তার মন খারাপ হয়ে যায়। সে বলে, এত্তোগুলান ট্যাহা দিয়া এই পচা বুদ্দি নিলা ক্যা?

এহনও দুই বান্ডিল আছে, আকালু বলে, দুই বান্ডিলেও অনেক ট্যাহা।

আকালুর কথায় টেপির মন খারাপ দূর হয়, কালো মুখে হাসি ফুটে ওঠে এবং বিকেলবেলায় সে পুনরায় গাছ, পাখি আর বাতাসের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। রাত হলে তারা খেয়ে শুয়ে পড়ার পর, মুখে গামছা বাঁধা পাঁচ জন লোক এসে তাদের ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে প্রাঙ্গণের আমগাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধে এবং তারপর ঘরের মেঝে খুঁড়ে টাকাগুলো নিয়ে যায়। আকালু আর টেপি সারা রাত আমগাছের সঙ্গে ঝুলে থাকে, মুখে কাপড় গুঁজে দেওয়া থাকায় তারা কোনো শব্দ করতে পারে না; তবে সারা রাত ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে সকাল বেলায় টেপি তার মুখের কাপড়টা ছিঁড়ে ফেলে এবং চিৎকার করতে থাকে। আকালু তার মুখের কাপড় সরাতে পারে না, সকাল থেকে ক্রমাগত তিন ঘণ্টা টেপি চিৎকার করার পর গ্রামের কুদ্দুস মৌলবি খালের পাড়ে ছাগল বাঁধতে এসে সেই চিৎকার শোনে; এবং সে যখন আকালু আর টেপিকে গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় দেখে, সে টেপির চাইতেও জোরে চিৎকার করতে করতে গ্রামের দিকে ছুটে যায়। কুদ্দুস মৌলবির এই পাগলামি দেখে গ্রামের লোকেরা আকালুর ভিটেয় গিয়ে আকালু আর টেপিকে পায়। তারা দড়ি খুলে তাদের দুজনকে মুক্ত করার পর ঘরের মেঝে দেখে বিস্মিত হয়ে পড়ে।

ডাকাইত আইছিল, গ্রামের লোকেরা বলে, কী আছিল রে এইখানে?

কী জানি, জানি না তো, আকালু বলে। তখন, যখন গ্রামের লোকেরা তৈরি হয় আকালুকে থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য, আকালুর বেদম পেটব্যথা শুরু হয় এবং সন্ধে পর্যন্ত এই ব্যথা যায় না। সে দুহাতে পেট চেপে ধরে ধুলোর ভেতর পড়ে থাকে, তারপর সন্ধে গড়িয়ে অন্ধকার নামলে উঠোনের ধুলো থেকে উঠে আসে, তখন টেপি ম্লান মুখে বলে, তোমার প্যাটে কি ডাকাইতরা কিছু কইরছে?

আমার কিছু হয় নাই, আকালু বলে, কিন্তু এইখানে আর থাকা হবি না টেপি, ডাকাতির কথা শুইনা কাইল পুলিশ আইসপোনি, আর পুলিশ আইসলেই ট্যাহার কথা জাইনা যাইবনি; আর অমনি জেলে। আইজ রাইতেই শেষ রাইত, কাইল ফজরে সিরাজগঞ্জ যায়া লঞ্চ ধইরা নদী পার হমু, তারপর ঢাহা যামু। তুই তৈরি হোয়ানে, রাইত দুই পহরে হাঁটা দিমু।

পরদিন সকালে গ্রামের লোকেরা এসে দেখে যে, আকালু নাই, তার বউ টেপিও নাই, ঘর ধু ধু ফাঁকা। অন্যদিকে তখন আকালু আর টেপি লঞ্চের খোলের ভেতর বেঞ্চিতে বসে যমুনা পার হয় এবং যমুনা পার হয়ে ভূঞাপুর থেকে বাসে চেপে বেলা তিনটার সময় তারা ঢাকার গুলিস্তানে এসে নামে। সে সময় দয়াগঞ্জের রিকশাওয়ালা চান্দু বাসস্ট্যান্ডের কাছে সোয়ারির অপেক্ষায় ছিল; ভূঞাপুরের বাস থেকে আকালু নামতেই চান্দু চমকে যায় তাকে দেখে, আরে দোস্ত, তুই? চান্দু চিৎকার করে কিন্তু আকালু খেয়াল করে না, সে ভিড়ের ধাক্কায় বউয়ের হাত ধরে এগিয়ে যেতে থাকে। চান্দু যখন দেখে যে, চিৎকার করে লাভ হচ্ছে না, সে রিকশা রেখে এগিয়ে এসে আকালুর কাঁধের কাছে ছেঁড়া জামা খামচে ধরে।

আবে হালারজানা, তুই দেখচ না আমারে?

আকালু ভয় পেয়ে যায়, তার মুখ শুকিয়ে আসে, টেপির হাত ধরে থেকেই সে বলে, ম্যাবাই?

চান্দু এবার সত্যি অবাক হয় এবং বেদনার সঙ্গে বলে, আবে হালায় জয়নাল, তুই আমারে চিনা পারতাছচ না, দোস, তুই আমারে হাচাই চিনা পারতাছচ না? আমি চান্দু, দোস, আমি চান্দু!

আকালু ঢোক গেলে, টেপি ভয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

আবে আমি চান্দু, চান্দু; তুই জয়নাল না? তুই আমারে চিনা পারতাছচ না দোস!

এবার আকালু ব্যাপারটা বুঝতে পারে, সে পুনরায় ঢোক গিলে বলে, আমার নাম আকালু, ম্যাবাই; আর এইটা আমার বউ, টেপি।

চান্দুর দন্তরাজি হাসিতে বিকশিত হয়, সে বলে, আ তর বউ? কী নাম কইলি?

টেপি।

আ টেপি! আ দোস্তানি, বুহুত মিডা নাম আপনের। আমার বউয়ের নাম হালায় হাওয়া বিবি!

আকালু আর টেপি চুপ করে থাকে, চান্দু বলে, তুই কই ভাগছিলি দোস? হেই যে তুই ভাইগগা গেলিগা, হ্যার বাদে কত বছর পর তুই ফিরা আইলি! তরে যে আমি কত বিচরাইছি, কত বিচরাইছি; ব্যাকতে কয় জয়নাইল্যা মইরা গেছে গা, আমি ওগো কথা হুনি না, আমি কই, না জয়নাল মরেনিকা! কই ভাগছিলি তুই দোস?

আকালু ভয়ে ভয়ে বলে, আমার নাম আকালু।

চান্দু আকালুর কথা শোনে না, সে বলে, তুই জয়নাল, আমি জানি। অখনে তুই কই যাইতাছচ?

আকালুর ভয় যায় না, কিন্তু সে সত্যি কথাই বলে যে, সে জানে না সে কোথায় যাবে। তখন চান্দু বলে, তুই আমার লগে চল, আবে আমি থাকতে তুই কয়া পারচ না, তুই কই যাবি! আবে চান্দু কি মইরা গেছে নিহি!

আকালুর সন্দেহ যায় না, টেপি ঘোমটার ফাঁক দিয়ে দেখে। আকালু বলে, আমি কিন্তু আসলে আকালু, সিরাজগঞ্জ থেইক্যা আইছি।

চান্দু তখন গম্ভীর হয়ে তাকায় এবং বলে, তর আগের নামটাই ভালা আছিল। জয়নাল বদলায়া করছচ আকালু। আকালু, হু হু, কেমুন নাম!

আকালু এবার খেপে যায়, বলে, আকালুই ভালো। তোমার নাম তো চান্দু! চান্দু!

আকালু এবং চান্দুর কথা শুনে টেপির হাসি পেয়ে যায়, সে আকালুর হাত টেনে ধরে বলে, চলো, বাইয়ের নগেই যাই।

আকালু আর টেপি দয়াগঞ্জ বস্তিতে চান্দু আর হাওয়া বিবির পাশের ঝুপড়িতে বসবাস শুরু করে। বস্তির লোকেরা যারা আকালুর নাম চান্দুর মুখে শোনে তারা জানে ওর নাম জয়নাল, আর যারা আকালুর নিজের কাছ থেকে শোনে, তারা জানে ওর নাম আকালু; কেবল টেপির নাম ঠিক থাকে। চান্দু আকালুকে ধূপখোলার মাঠে নিয়ে গিয়ে রিকশা চালানো শেখায় এবং দয়াগঞ্জের এক মহাজনের কাছ থেকে একটি রিকশা জোগাড় করে দেয়। আকালুর খুব আনন্দ হয়, কিন্তু টেপির মন ভার হয়ে থাকে এবং আকালু বুঝতে পারে না টেপির মন খারাপ কেন। তখন একদিন রাতে মেঝেতে চাটাই এবং কাঁথার উপর শুয়ে আকালু জিজ্ঞেস করে, তর কী হইছে রে টেপি?

আকালুর থুতনির কাছ থেকে টেপি বলে, প্যাটের ভিতর কেমন জানি নাগে!

কেমন নাগে?

মনে হয় পাথর পাথর।

পরদিন আকালু চান্দুকে বলে, ভাই চান্দু, আমার বউ টেপির খুব শরীর খারাপ, অর প্যাটে পাথর হইছে।

চান্দু চিন্তা করে বলে, ঠিক আছে দোস্তানিরে ডাক্তারেরঠে লয়া চলো; এবং তারা টেপিকে হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার টেপির রক্ত এবং প্রস্রাব পরীক্ষা করে, পেটের এক্স রে ছবি তুলে দেখে, কিন্তু কিছু পাওয়া যায় না; এতে টেপির মন আরো খারাপ হয়ে যায়, সে বলে, প্যাটের মইদ্দে মনে হয় এক মণ ভার, কিন্তু ডাক্তার কয় কিছু না; আর বাঁচপ না, আমি মইরা গেলে তুমি আর একখান বিয়া কইরো। টেপির কষ্টে আকালুর মন খারাপ হয়ে যায়, রাতে সে বউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে এবং সেদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে যে, টেপি তার বাহুর ভেতর নাই। সে তখন বাইরে বের হয়ে খুঁজতে শুরু করে এবং রেললাইন পার হয়ে একটি খালি জায়গায় টেপিকে দেখতে পায়; টেপি এই ফাঁকা জায়গায় আস্তে আস্তে হেঁটে বেড়ায়, সে আকালুকে দেখে না। তখন একটি দাঁড়কাক উড়ে এসে এই স্থানটির এক প্রান্তে পুঁতে রাখা একটি বাঁশের মাথায় বসে এবং কয়েকবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে ডেকে ওঠে কাওয়া কাওয়া করে। টেপি কাকটাকে দেখে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার কথা বলা শুরু হয়ে যায়।

আহা রে, তুই সেই কাউয়াটা না? কইন থেইক্যা আইসলি, সিরাজগঞ্জ থেইক্যা? আহা রে, তুই আমাগোরে দ্যাশের কাক!

কাকটা ঘাড় কাত করে টেপির কথা শোনে, টেপি বলে, আহা রে কতদূর থেইকা উইড়া আইছিস, খুব কষ্ট নাইগত্যাছে? কিন্তু তুই একা ক্যা, একা ক্যা রে তুই?

কাক চুপ করে তাকিয়ে থাকে, টেপি তখন কাঁদতে শুরু করে, মইরা গ্যাছে, আহা রে; মইরা গ্যাছে, না?

তখন আকালু এগিয়ে যায় এবং টেপি তাকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে, কিন্তু আকালুর কোনো মায়া হয় না, সে খেপে যায়, বলে, এই কাক শালার ব্যাটা হারামি, এই শালাক মারমু। কিন্তু টেপি তাকে ঢিল ছুড়তে দেয় না, সে দৌড়ে গিয়ে নিজের ঝুপড়ি থেকে সিলভারের একটি ডেকচিতে করে পানি এনে কাককে খেতে দেয়, কিন্তু কাকটি কেবল তাকিয়ে থাকে, খায় না। আকালু যখন খেয়াল করে যে, তার বউয়ের 

কাণ্ড দেখার জন্য লোক জড়ো হয়ে গেছে, সে তখন টেপিকে ঘরে নিয়ে আসে। বস্তির লোকেরা বলে যে, টেপির মাথায় ছিট আছে, আর টেপি অনেক দিন পর পুনরায় ঘরের আনাচে-কানাচে, কলতলায় বিড়বিড় করে বেড়াতে থাকে এবং তা শুনে আকালুর মন আনন্দে ভরে যায়। তিন দিন পর আকালু সোয়ারি নিয়ে দয়াগঞ্জ থেকে যাত্রাবাড়ী যাচ্ছিল, তখন গুলিস্তানগামী একটি বাস এগিয়ে আসতে দেখে যাত্রীটি রিকশা থেকে নেমে চোখের পলকে চলন্ত বাসের ভেতর লাফিয়ে উঠে যায়। আকালু তার ভাড়ার জন্য চিৎকার করার আগেই সে দেখে যে, লোকটির পেছনের পকেট থেকে তার মানিব্যাগটা ছিটকে নিচে পড়ে যায় এবং লোকটি তা বুঝতেও পারে না। সে তখন 

দ্রুত ব্যাগটা কুড়িয়ে নিয়ে গেঞ্জির নিচে লুকিয়ে ফেলে, তারপর সে খানিকটা দূরে সরে গিয়ে ব্যাগটা বের করে টাকা গুনে দেখে, একাত্তর টাকা আছে ব্যাগে। এই সময় তার গাছের ফোকরে পাওয়া টাকার কথা মনে পড়ে এবং সে ভয় পায়। সে মানিব্যাগ থেকে তার ভাড়া এক টাকা নিয়ে নিজের ট্যাঁকে গোঁজে, বাকি সত্তর টাকা ব্যাগের ভেতরেই রেখে দেয় এবং নারিন্দা পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। ফাঁড়িতে তখন তিন জন পুলিশ উপস্থিত ছিল, আকালু ডিউটি অফিসারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় এবং বলে, ছার, আমি একখান ট্যাহার ব্যাগ কুড়ায়া পাইছি ছার।

ডিউটি অফিসার ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকায়।

তর নাম কী?

আকালু।

ডিউটি অফিসার ব্যাগের টাকা গুনে দেখে।

ব্যাগে কত টাকা ছিল?

একাত্তর ট্যাহা, না সত্তর ট্যাহা।

ঠিক কইরা ক কত টাকা ছিল মানিব্যাগে।

আকালু তখন ভয় পেয়ে যায়, বলে, একাত্তর ট্যাহাই আছিল, আমি আমার ভাড়া এক ট্যাহা নিছি।

ডিউটি অফিসার তখন, হারামজাদা চোর বলে উঠে গিয়ে আকালুর পাছায়, ঊরুতে এবং কাঁধে আধ মিনিট ধরে একটি মোটা এবং গাঁটওয়ালা লাঠি দিয়ে পেটায়। মার খেয়ে আকালু হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে, ছার, আমি চোর না ছার, আমি ট্যাহা চুরি করি নাই।

অন্য দুজন পুলিশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল, ডিউটি অফিসারটি তখন নিজের চেয়ারে ফিরে গিয়ে বসে, এবং বলে, তর কাছে কত টাকা আছে বাইর কর।

আকালু তার লুঙ্গির খুঁট থেকে ছয় টাকা বের করে টেবিলের উপর রাখে।

হুম, ডিউটি অফিসার বলে, সাতাত্তর টাকা তো ভাগ করাই মুশকিল, শালার নব্বইটা টাকা হইলে সুবিধা হইত। তারপর সে আকালুকে বলে, তর কাছে আর টাকা নাই?

না ছার, আল্লাহর কছম কই ছার।

আর একটা টাকা হইলেও তো ভাগ করা যায়। আর একটা টাকাও হইব না তর কাছে? শালা শুয়োরের বাচ্চা।

আকালু আবার হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে, ডিউটি অফিসার তখন অনেক ভেবেচিন্তে বলে, শালা হারামির বাচ্চা এমন হিসাব কইরা আনছে যাতে তিন ভাগ করা না যায়। কিন্তু তোমাক শালা ছাড়ব না, দুপুরের আগে আরো তেরো টাকা আইনা দিয়া যাবি, না দিলে শালা তোমাক ধইরা ঠ্যাং ভাইঙ্গা দিমু।

আকালু হাউমাউ করে, আল্লাহ নবীর কসম কেটে বলে যে, এই টাকা সে অবশ্যই দিয়ে যাবে। তখন পুলিশেরা তার রিকশার নম্বর লিখে রেখে তাকে ছেড়ে দেয়। সেদিন দুটোর পর রিকশা জমা দিয়ে বাড়ি ফিরে আকালু গম্ভীর হয়ে থাকে; টেপি এ কথা বলে, ওকথা বলে, কিন্তু আকালুর নীরবতা ভাঙে না; তখন টেপির মুখ ভয়ে কালো হয়ে আসে এবং সে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, ওগো তোমরা সকলে আসো, দেখো, এই মানুষটার যানি কী হয়া গ্যাছে! টেপির কান্না শুনে পড়শিরা দৌড়ে আসে, চান্দু এবং হাওয়া বিবিও আসে; তারা দেখে যে, ঝুপড়ির দরজার গোড়ায় আকালু নির্বাক হয়ে বসে আছে। আকালু কারো সঙ্গে কথা বলে না, অন্য সকলে চলে যাওয়ার পর সে চান্দুকে বলে, দোস্তো আমার খুব বিপদ।

কান্না থামিয়ে টেপি এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এবার আকালুর কথা শুনে সে পুনরায় হাউমাউ করে ওঠে। চান্দু বলে, তুই ডরাইছ না, চান্দু থাকতে তর কুনো ডর নাই, তুই আমারে ক তর কী হইচে।

দাঁড় কাউয়ায় আমার পিছে নাইগছে, আর বাঁচপ না।

কাউয়া!

হেঁ, একটা দাঁড়কাক, একবার গ্রামে যায়া আমাক গ্রামছাড়া কইরছে, এহন ঢাহায় আইসা হাজির অইছে; আইজ আর এট্টু হইলে হাজতে গেছিলাম।

চান্দু আকালুর কথা শুনে গুম মেরে থাকে সারা দিন, তারপর সন্ধের সময় বলে, ডরাইস না, তরে জ্যোতিষ বাবারঠে লয়া যামুনে, এমুন একখান পাত্থর তরে দিব যে ব্যাবাক বালা-মুছিবত কাইটা যাইবগা।

চান্দুর কথায় আকালু এবং টেপির মনে সাহস ফিরে আসে এবং আকালু পুনরায় টেপির গুনগুন শুনতে পায়। সন্ধের পর আকালু চান্দুর সঙ্গে জ্যোতিষের কাছে যায়; নাজিরাবাজারের গলির ভেতর একটা আধো-অন্ধকার ঘরে আকালু তার ডান হাতের তালু চিত করে পেতে বসে থাকে আর আধবুড়ো জ্যোতিষ তার হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাগজের উপর অনেকক্ষণ ধরে আঁকিবুকি কাটে। তারপর জ্যোতিষ আকালুকে অনেক কথা বলে, যার প্রায় কিছুই সে বুঝতে পারে না; তবে জ্যোতিষ যখন বলে যে, তার ওপর শনির নজর আছে, তখন সে হাউমাউ করে ওঠে, জ্যোতিষ বাই, আপনে আমাক বাঁচান। চান্দু এবং জ্যোতিষ তাকে অনেক সান্ত¡না দেয়, জ্যোতিষ বলে, ডরায়ো না, তোমারে আমি একটা নীলা পাথর দিমু, হাতে পরবা, ইনশাল্লাহ সব মুছিবত কাইটা যায়া তুমার জীবনে তরক্কি হইব।

নীলা পাথর কী?

এইটা নীল রঙের একটা পাথর, নীল নদীর দ্যাশ আছে, সেইটা সোলেমান বাদশার দ্যাশ। সেইখান থন এই পাথর আইনা ব্যাপারীরা পাটুয়াটুলির গলির ভিতরে বেচে, আমারঠেও আছে, তুমারে একটা দিমু।

কত পয়সা নাগবি? আকালু জিজ্ঞেস করে।

পাথরের দাম পঞ্চাইশ ট্যাকা, আর আংটির দাম দশ ট্যাকা, মোট লাগব ষাইট ট্যাকা। আকালু অবাক হয়ে যায়। একটি ছোট্ট পাথরের দাম পঞ্চাশ টাকা! চান্দুকে সে বলে যে, তার কাছে মাত্র বিশ টাকা আছে, তখন চান্দু তাকে ত্রিশ টাকা ধার দেয় এবং এই পঞ্চাশ টাকা দিয়ে সে হালকা নীল রঙের একটি পাথর কেনে, কোনো আংটি কেনে না, সে বলে, কাপড় দিয়া হাতের নগে বাইন্দ্যা নিলেই হইবনি। তখন নাজিরাবাজার এলাকার সব বিজলি বাতি নিভে যায়। আকালু আর চান্দু জ্যোতিষের ছোট্ট ঘরের ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর কিছুক্ষণ বসে থাকে, তারপর অন্ধকারের ভেতরেই তারা ঘর থেকে বের হয়ে আসে। বাড়ি ফিরে আকালু পাথরটা টেপিকে দেয়, টেপি সেটা শাড়ির আঁচলের খুঁটে ভালো করে গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখে। পরদিন টেপি পুরোনো কাপড় দিয়ে একটি বাজুবন্ধ বানায় এবং তার ভেতর পাথরটা পুরে বালিশের মতো সেলাই করে দেয় এবং আকালু টেপির বানানো এই বাজুবন্ধ ডান হাতের কনুইয়ের উপর বেঁধে রিকশা নিয়ে বের হয়ে যায়। সেদিন দুপুর দুটো পর্যন্ত আকালুর সাতাশ টাকা আয় হয়, ঘরে ফিরে টেপিকে দিলে টেপি আনন্দ ও বিস্ময়ে গুনগুন করে বলে, একদিনে এক কুড়ি সাত ট্যাহা!

আকালু একই রকম খুশি হয়ে বলে, খাড়া না, দেখ না কী অয়; এই পাথর নীল নদীর সোলেমান বাশ্শার দ্যাশ থেইক্যা আইনছে, এইবার তর ঘর আমি সোলেমান বাশ্শার ট্যাহা দিয়া ভইরা দিমু; তুই খালি খাবি আর গুনগুনাবি।

তার পরদিন আকালুর বত্রিশ টাকা রোজগার হয়। টেপি আকালুকে খুশি করার জন্য বিকেলে ধোয়া কাপড় পরে এবং তেল দিয়ে চুল বাঁধে। কিন্তু তার পরদিন বস্তিতে পুলিশ এসে হাজির হয় এবং দুদিন আগে সন্ধ্যের পর বিদুৎ চলে গেলে নাজিরাবাজারের জ্যোতিষ ভাস্করের কাচের কেসের ভেতর থেকে রত্নরাজি চুরি করেছে এই অভিযোগে আকালুকে তার ঝুপড়ি থেকে পাকড়াও করে। পুলিশ চান্দুকেও খোঁজে, কিন্তু সে খবর পেয়ে পালায়। আকালু এবং টেপি ভালো করে কিছু বুঝতে পারার আগেই পুলিশ আকালুকে নিয়ে গিয়ে সূত্রাপুর থানা হাজতে ভরে রাখে। পুলিশ যখন তার কোনো কথা শোনে না বরং দু-তিনবার তাকে বেধড়ক মারপিট করে, তখন অবস্থাটা সে বুঝতে পারে; সে বুঝতে পারে যে, এবার তার জেলে যাওয়াটা নিশ্চিত এবং তখন দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে ডিউটি অফিসারকে বলে যে, চান্দুর সঙ্গে সেও চুরি করে এবং তাদেরকে এই চুরির বুদ্ধি দেয় তার স্ত্রী, টেপি। তার এই কথায় কাজ হয়, ডিউটি অফিসার দুজন কনস্টেবলকে পাঠায় টেপিকে ধরে আনার জন্য। রাত দশটার সময় ভীত এবং বিবর্ণ টেপিকে এনে হাজতের লোহার দরজা খুলে ভেতরে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে পুলিশ চলে গেলে সে রাতে আকালু প্রহার-পীড়িত শরীরে টেপিকে জড়িয়ে ধরে হাজতের মেঝের উপর ঘুমায়। পরদিন পুলিশ তাদের কোর্টে চালান করে দেয় এবং বিচারে ওদের দেড় বছর করে সাজা হয়। জেলখানার ভেতর পৃথক ওয়ার্ডে থাকলেও, দিনের বেলা তারা জেলের প্রাঙ্গণের লোহার বেড়ার দুপাশে দাঁড়িয়ে কথা বলে কাটায়। এভাবে চৌদ্দ মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর আকালু যে সেলে অন্য আরো এগারো জন কয়েদির সঙ্গে থাকে তার পশ্চিম ধারের দেয়ালে, অনেক উঁচায় আলো আসার ফোকরের ভেতর একদিন সে কিছু খড়কুটোর ছায়া দেখতে পায় এবং খুব শীঘ্রই একদিন সে দেখে যে, এই খড়কুটোর উপর একটি কালো রঙের পাখি বসে আছে এবং আকালু তৎক্ষণাৎ ব্যাপারটি বুঝতে পারে। সে সেদিনই অনেক অনুনয়-বিনয় করে জেলার সাহেবের সঙ্গে দেখা করে এবং তার সেল বদল করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করে বলে, আমাক বাঁচান ছার, এই কাউয়া আমাক শ্যাষ কইরা ফালাইব! আকালুর সব কথা শুনে প্রবীণ জেলারের কাছে মনে হয় যে, এগুলো গল্প, সেল বদলাতে চাওয়ার পেছনে এই লোকের আসল মতলব কী তা সে অনুমান করতে পারে না, সে আকালুর আবেদন নাকচ করে দেয়; ফলে এরপর আকালুর ধারণানুযায়ী ঘটনা মোড় নেয়। কয়েক দিন পর আকালু জ্বরাক্রান্ত হয়ে দিনের বেলায় সেলের মেঝেতে কাপড় পেতে শুয়ে ছিল, তখন তন্দ্রাচ্ছন্নতার ভেতর তার মনে হয় যেন একটি পাখির বিস্তৃত পাখার ছায়া নিঃশব্দে তার শরীর অতিক্রম করে যায়। আকালু একবার তার জ্বরতপ্ত চোখের পাতা খুলে তাকায়, কিন্তু কিছু দেখে না। তারপর বিকেলের দিকে সেলের ভেতর যখন আলো কমে আসে তখন সে উঠে বসে এবং তার ঊরুর নিচে খোয়ার কুচির মতো শক্ত একটা কিছু অনুভব করে, সে হাত দিয়ে বস্তুটা সরাতে গিয়ে সেটাকে সামনে নিয়ে আসে এবং দেখে যে, তার দেহের নিচে যে বস্তুটি চাপা পড়েছিল সেটা একটি আংটি। সোনার তৈরি সেই অসাধারণ সুন্দর আংটির উপর একটি বড় আকারের কোনাতোলা পাথর বসানো, এই পাথর থেকে ঘরের আবছা অন্ধকারেও জ্যোতির্ময় আলো বিচ্ছুরিত হয়। আকালু আংটিটি মেঝেতে ছুড়ে ফেলে হাত দিয়ে মুখ ঢাকে এবং সম্ভবত সে সময় তার মুখ দিয়ে কোনো কাতর শব্দ নির্গত হয়; কারণ ঠিক তখন, সেই সেলের অন্য এক বাসিন্দা, ছিঁচকে চোর আবুল হোসেন ভেতরে প্রবেশ করে বলে ওঠে, কী হইছে তোমার?

আকালু চোখের উপর থেকে হাত সরায় না, অন্য হাত দিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা আংটির দিকে ইঙ্গিত করে দেখায়; তখন আবুল হোসেন এগিয়ে এসে আংটিটা কুড়িয়ে নিয়ে হতবাক হয়ে পড়ে।

এইটা কই থেইকা আইলো?

কাকে ফালাইছে।

এইটা এখন কী করবা?

তুমি নিয়্যা নেও।

আকালুকে এই আংটির কথা আর কাউকে বলতে বারণ করে আবুল সেটা তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের ভেতর লুকিয়ে রাখে। দশ দিন পর এই আংটি পাচার করে বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় আবুলের স্ত্রী ধরা পড়ে এবং জেলারের সামনে আবুলকে ডাকা হলে সে কাঁপতে থাকে এবং বলে যে, আংটিটা তাকে আকালু দিয়েছে। তখন আকালুর ডাক পড়ে এবং সিপাইরা তাকে খুঁজে বের করে আনলে সে বলে যে, সে যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন কাকের বাসা থেকে তার গায়ের উপর সেটা এসে পড়ে।

এইটা কার আংটি?

তা তো আমি কইতে পারি না, ছার।

হারামজাদা, তুমি মিছা কথা কও!

না ছার, এইটা ছার কাউয়ায় ফালাইছে, এইটা আপনে নিয়া নেন।

জেলার সাহেব তখন একটু ভাবেন এবং আংটিটা তার টেবিলের ড্রয়ারে রেখে আকালুকে ছেড়ে দেন; তখন আকালু ফিরে গিয়ে দেখে যে, দূরে এক কড়–ইগাছের তলায় টেপি বিষণ্ন মুখে বসে বিড়বিড় করছে। চার মাস পর তাদের দুজনকে ছেড়ে দেয়া হয়।

তখন সেই জেলার সাহেব তাদের দেখতে পায় এবং তার অফিস ঘরে ডেকে আনে।

তোমরা এখন কোথায় যাইবা?

যাওয়ার জায়গা নাই ছার।

জেলার সাহেব তখন তাদের নিজের সরকারি জিপে চড়িয়ে মগবাজারের পূর্বপ্রান্তে নয়াটোলায় নিয়ে আসে; এখানে চারদিকে বিস্তৃত খালি জায়গার মাঝখানে দেয়ালঘেরা একটি প্রাঙ্গণে তারা এসে প্রবেশ করে। আকালু এবং টেপি এই প্রাঙ্গণের মাঝখানে একটি তালগাছ এবং তালগাছের নিচে একটি ঝুপড়ি দেখে, জেলার সাহেব ঝুপড়ির দরজার তালা খুলে বলে, এইটা আমার জায়গা, একটা লোক ছিল পাহারা দিত; সে চইলা গেছে, এখন তোমরা থাকো। এই ঝুপড়ির ভেতর টেপি তার সংসার পুনরায় গড়ে তোলে; আকালু কামলা খাটার কাজ করে, টেপি শাহনূরীর মাজারের কাছে এক বাসায় ছুটা ঝিয়ের কাজ নেয়। এভাবে কয়েক মাস যাওয়ার পর একদিন সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আকালু টেপিকে চুপচাপ ঘরের দরজায় বসে থাকতে দেখে।

কী হইছে তর?

কাউয়া আইসা গেছে।

তখন উপর দিকে তাকিয়ে তালগাছের শাখায় আকালু মাথা নিচু করে বসে থাকা দাঁড়কাকটিকে দেখতে পায় এবং তারপর আকালু এবং টেপি বিস্ময় ও আতঙ্কের সঙ্গে দেখে যে, তালগাছের শাখায় রাত্রি যাপনকারী কাকের সংখ্যা প্রতিদিন ক্রমাগতভাবে বেড়ে যেতে থাকে। সহসাই তালগাছ এবং তাদের কুঁড়েঘরের ছাদে কাকদের স্থান সংকুলান না হওয়ার অবস্থা হয়; তখন আকালু এবং টেপি, মনে হয় যেন বহুদিন পর, তাদের ভবিতব্যকে মেনে নেয়; দুজনের কাজ করা উপার্জিত পয়সা দিয়ে আকালু বড় বড় বোরাক বাঁশ কিনে আনে এবং তাদের প্রাঙ্গণ জুড়ে মাথার উপর দিয়ে একান্নটি লাইনে, প্রতি লাইনে তেরোটি করে সর্বমোট ছয় শ তেষট্টিটি আড়া বেঁধে দেয়। মহল্লার লোকেরা প্রথমে বিষয়টি খেয়াল করে না, অথবা খেয়াল করলেও গুরুত্ব দেয় না; প্রথমে তারা কেবলমাত্র এ রকম ভাবে যে, নির্মাণকর্মের জন্য বাঁশের মাচা বাঁধা হয়েছে। তবে ক্রমান্বয়ে তারা এই এলাকায় কাকের অধিক উপস্থিতির বিষয়ে সচেতন হয়, এবং একসময় দেখে যে, পত্রপল্লবহীন বৃক্ষশাখায় ধরা ফলের মতো আকালুর বাঁশের কাঠামো কালো কাকে ছেয়ে যায়। তারা কেউ কেউ আকালু এবং তার স্ত্রীকে কাকের প্রসঙ্গটি জিজ্ঞেস করলে তারা পরিষ্কার করে কিছু বলে না, আকালু দিনমজুরি এবং টেপি বাসায় ঝিয়ের কাজ করে সন্ধ্যায় যখন ঘরে ফেরে তখন তাদের সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে কাক তাদের বাঁশের উন্মুক্ত খাঁচায় ফিরতে থাকে। মহল্লার লোকেরা, কাকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পরও প্রথম দিকে নির্বিকার থাকে, তবে পরবর্তী জ্যৈষ্ঠ মাসে যখন এখানে জন্মানো কাকের ছানারা উড়তে শুরু করে এবং কাকের বাসা ভেঙে আকালু সাড়ে আঠারো মণ সাইকেলের স্পোক, লোহার তার, ইস্পাতখণ্ড বিক্রি করে মহল্লার লোকেরা তখন বিষয়টির প্রতি সচেতন হয়। তারা এই গ্রাম্য লোকটি এবং তার স্ত্রীর ব্যবসা-বুদ্ধিতে চমৎকৃত হয়, এবং তাদের এই বিস্ময়বোধ একধরনের আকাঙ্ক্ষা এবং ঈর্ষায় রূপ নেয় যখন তারা জানতে পারে যে, এই এলাকার রাস্তার ঝাড়ুদারনি নিমফল দাসীকে একদিন বাসার ভেতর ডেকে নিয়ে টেপি কাকের ডিমের ভাজি খাওয়ায় এবং বিদায়ের সময় ঝুপড়ির বাঁশের ফোকরের ভেতর থেকে কাকের বাসায় পাওয়া একজোড়া সোনার দুল বের করে দেয়। তখন নয়াটোলা মগবাজার এলাকার অনেক লোক কবুতর পোষা ত্যাগ করে তাদের কবুতরের খোপ এবং প্রাঙ্গণের বাঁশের উঁচু মাচা কালো কাকের জন্য খালি করে রাখে। কিন্তু ক্রমাগত ছমাস চেষ্টা করে তারা কাকের আবাদ করতে ব্যর্থ হয়, তখন একদিন সন্ধেবেলা তারা আকালুর বাসার পাঁচিলের বাইরে গেটের সামনে এসে জড়ো হয় এবং আকালুকে ডেকে বার করে বলে, তুমি ঝাড়–দারনিরে সোনার দুল দিছ, আমাগোও দেওন লাগব।

আমি দেই নাই, আকালু বলে, আমার বউ দিছে।

তুমার বউরে ডাকো।

ও রান্দে।

তুমরা কাউয়ার আন্ডা খাও ক্যান?

ভালো নাগে তাই খাই, আপনেরা খাইবেন?

না কাউয়ার আন্ডা আমরা চাই না, ঝাড়–দারনিরে যা দিছ আমাগো তা-ই দিবা।

আচ্ছা দিমু, আকালু বলে, এহন নাই, পরে আবার পাইলে দিমু, এহন আপনেরা যান।

মহল্লার লোকেরা চলে যাওয়ার পর টেপি হাঁড়িতে সিদ্ধ করা নীল রঙের ডিমের খোসা ভেঙে আকালুকে খেতে দেয়।

মাইনষেরা আইছিলো কী কামে? টেপি জিজ্ঞেস করে।

তুই ঝাড়ুদারনিকে কানের দুল দিছিস, এহন ওরাও চায়, ওগোরেও দেওয়া নাইগব।

এত দুল এহন আমরা পামু কোনে?

ঝাড়ুদারনিকে দুল দিয়া তুই ঝামেলা বাজাইছিস, আর কোনোদিন কাউক কিছু দিবি না।

পরবর্তী ছমাস মহল্লার লোকেরা ক্রমাগতভাবে ফিরে যেতে যেতে বিরক্ত এবং রাগান্বিত হয়ে ওঠে; তারা আকালুর বাড়ি ফেরার পথে তেরো দিন তার ওপর কাঁঠালের ভুঁতি ছুড়ে মারে, তারপর পাঁচ দিন ছোড়ে পচা গোবর। মহল্লার লোকেরা যখন দেখে যে, তাদের অত্যাচারে আকালুর কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না, তখন তারা খুব হতাশ হয় এবং তখন তারা একদিন, বাসার পথে ছায়ার মতো হেঁটে আসা টেপির ওপর কুকুর লেলিয়ে দেয়; এবং সেদিনের পর তারা মহল্লার রাস্তায় আকালু আর তার স্ত্রীকে দেখতে পায় না। তারা কয়েক দিন অস্বস্তির সঙ্গে অপেক্ষা করে তারপর একদিন তারা কয়েক জন আকালুর বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়; তারা পাঁচিলের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাকের ডিম ভাজার গন্ধ পায় এবং দেখে যে, ভরা দিনের বেলাতেও আড়া ভর্তি কাক। তখন তিন জন লোক বাইরে থেকে দরজা খোলার চেষ্টা করে, কিন্তু দরজা খুলতে না পেরে তারা যখন দেয়াল টপকানোর চেষ্টা করে তখন এতক্ষণ নীরবে তাকিয়ে থাকা কাকদের ভেতর থেকে সাতটি পাতি এবং তিনটি দাঁড়কাক, মোট দশটি কাক আলতো করে বাঁশের আড়া ত্যাগ করে তাদের দিকে নেমে আসে। কাকদের এনে দেয়া সোনাদানা না পেয়ে মহল্লার এই লোকেরা এমনিতে খেপে ছিল, এবার কাকের ঠোকর খেয়ে তাদের ক্রোধ ভয়াবহ হয়ে ওঠে। কাকের আক্রমণে দেয়ালের উপর চড়ে বসা তিন জন লোক আহত হওয়ার পর অন্য লোকেরা পিছিয়ে গিয়ে আকালুর প্রাচীরঘেরা বাসাটার চারদিক ঘিরে ধরে। এভাবে তারা চার দিন চার রাত্রি পাহারা দেয়, তারা প্রতীক্ষা করে এই ভেবে যে, আকালু এবং টেপি মানুষ হয়ে থাকলে তাদের বাইরে বের হতেই হবে একদিন। কিন্তু এই অবরোধের ছাব্বিশতম দিন অতিবাহিত হয়ে যখন রাত নামে তখন আকাশে মেঘ জমে ওঠে এবং বৃষ্টি পড়তে থাকে এবং তারপর বৃষ্টি থেমে গিয়ে আরো দুদিন অতিক্রান্ত হয়; তখন অবরোধকারীদের অনেকে এই সত্যটি বুঝতে পারে যে, কাকের ডিম আর চাপকলের পানি খেয়ে আকালু এবং তার স্ত্রীর দিন ভালোই চলে যাবে, বাইরের পৃথিবীতে তাদের আর বের না হলেও চলবে এবং তখন এই লোকেরা অবরোধ ভেঙে ঘরে ফিরে যায়। কিন্তু ঝাড়ুদারনি নিমফল দাসীর কানে কাকদের এনে দেয়া সোনার দুল যেসব লোকের স্ত্রীরা দেখেছিল তারা সহসাই আবার অবরোধকর্মে ফিরে আসে এবং অবরোধের ত্রিশতম দিনের দিবাবসানের পর রাত্রি একটু গভীর হয়ে এলে আকালুর বাসার চারদিকে শুকনো ঘাস-পাতা জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। আগুনের ধোঁয়া এবং তাপে যখন প্রাচীরঘেরা বাড়িটা আচ্ছন্ন হয় তখন কাকেরা প্রথম বাঁশের আড়া ত্যাগ করে যেতে শুরু করে এবং তখন মহল্লার লোকেরা যারা আগুনের পাশে পাহারায় ছিল তারা বলে যে, হাজার হাজার, লাখ লাখ কাক উড়ে যায় এবং রাত কেটে যাওয়ার পর ভোরের প্রথম আলোয় এই লোকেরা কেল্লার মতো করে রচিত এই আড়াসমূহ এবং তালগাছের শাখা একেবারে খালি দেখতে পায়। তখন এই লোকেরা এক হাতে লাঠি, বল্লম, লোহার রড এবং অন্য হাতে একটি করে চটের ছালা নিয়ে প্রাচীরের দরজা ভেঙে আকালুর বাসার ভেতর প্রবেশ করে। পুরু হয়ে জমা কাকের বিষ্ঠা পার হয়ে তারা তালগাছের নিচে ঝুপড়ির ভেতর প্রবেশ করে এবং দেখে যে ভেতরে মানুষের কোনো চিহ্ন নাই; তবে ঘরের একপাশে চুলার উপর একটি অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে রয়েছে কাকের নয়টি সিদ্ধ ডিম। মহল্লার এই লোকেরা ছোট্ট কুঁড়েঘরের বেড়ার প্রতিটি বাঁশের গিঁট চিরে পরীক্ষা করে, মেঝের মাটি খুঁড়ে উলট-পালট করে, কিন্তু তারা সেখানে কিছুই পায় না। তখন তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয় যে গ্রামের এই আপাতসরল এবং অশিক্ষিত লোকটি এবং তার স্ত্রী অনেক চতুর এবং ধূর্ত ছিল, কারণ এত পাহারার ভেতরও তারা কাকদের এনে দেয়া সম্পদরাজি নিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছে। কিন্তু এদের ভেতর কিছু কিছু লোকের বিভ্রান্তি থেকে যায় এবং তারা বলে যে এ রকম একটানা পাহারা ভেঙে তাদের পালানো অসম্ভব একটি ব্যাপার ছিল; এবং তখন অন্য কিছু লোক বলে যে আকালুর ঝুপড়িতে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ির পানিতে যে নয়টি নীল রঙের সিদ্ধ ডিম পাওয়া যায়, সেগুলো খুব সম্প্রতি, সম্ভবত কাকদের উড়ে যাওয়ার রাতেই সিদ্ধ করা হয়; কারণ, চুলার উপরকার হাঁড়ির পানিতে হাত নিমজ্জিত করে তারা বুঝতে পেরেছিল যে এই পানি খুব পুরোনো নয় এবং পানির ভেতর হাতের মুঠোয় কাকের সিদ্ধ ডিম নিয়ে তারা নিশ্চিতরূপেই একটি হালকা উষ্ণতা অনুভব করে। আকালু এবং টেপির, অবরোধ ভেঙে অন্তর্ধানের বিষয়ে নয়াটোলার লোকদের বিভ্রান্তি আরো প্রবল হয়ে ওঠে যখন মহল্লায় এই কাহিনি প্রচারিত হয় যে আসলে ওই কাকেরা তাদের বাঁশের আড়া ছেড়ে উড়ে যাওয়ার সময় আকালু এবং টেপিকে ঠোঁটে করে নিয়ে যায়। মহল্লার লোকেরা এই কথা বলে যে, যে রাতে আকালুর বাসায় বাঁশের আড়ার কাকেরা আগুনের তাপ আর ধোঁয়া সহ্য করতে না পেরে উড়ে যায়, সে রাতে, তখন রামপুরা ঝিলের কিনারায় কিছু লোক নৌকা বেঁধে পাটাতনের উপর শুয়ে ছিল। যখন নৌকার মাঝিরা নৌকার পাটাতনের উপর চিত হয়ে শুয়ে বিড়ি ফুঁকে গল্প করছিল তখন তারা একসময় দেখে যে সহস্র করতালির মতো পাখার আওয়াজ তুলে বিশাল একঝাঁক পাখি উড়ে যায়। তারা দেখে যে  এই উড়ন্ত পাখিতে আকাশের চতুর্দিক প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে; চিত হয়ে শুয়ে এই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় তারা দেখতে পায় যে একটি বা দুটি জায়গায় পাখিরা যেন পিঁপড়েদের মতো দলা বেঁধে আছে; কিন্তু তারপর তারা বুঝতে পারে যে আসলে একটি জায়গায় বেশি পাখি জড়ো হয়ে যায়নি, বরং পাখিরা কী যেন মুখে করে শূন্য দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। প্রথমে তাদের কাছে মনে হয় যেন দুটো কাপড়ের টুকরো, কিন্তু তারপর পশ্চাৎপটে আকাশের আবছা আলোয় উড়ন্ত পাখিদের ভিড়ে তারা দুটো মানুষের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখে। এই কালো পাখিরা রামপুরার ঝিলের উপর দিয়ে ধলেশ্বরীর কুয়াশার ভেতর উড়ে যায়।

এই ঘটনার পর ঢাকা কাকশূন্য হয়ে পড়ে এবং ঢাকার প্রবীণ লোকেরা এখন মনে করতে পারে যে সেইসব দিনে কলতলা থেকে সাবান হারানোর ঘটনা একেবারে বন্ধ হয়ে আসে; কিন্তু একই সঙ্গে রাস্তায় অপরিষ্কৃত আবর্জনার স্ত‚প জমে যেতে থাকে এবং শহরের আকাশ পাখিহীন একঘেয়ে হয়ে ওঠে। এভাবে বহুদিন কেটে যায়, তারপর আশপাশের মফস্বল থেকে কিছু কাক আসে এই শহরে এবং মফস্বলের এই কাকেরা নতুন প্রজন্মের কাকের জন্ম দিয়ে শহরের আকাশ পুনরায় ভরে তোলে।

১৯৯২

“কাঠুরে ও দাঁড়কাক” ('kathure o darkak') by Shahidul Zahir, was first published under the title শহীদুল জহীর সমগ্র ('Shahidul Zahir Samagra') by Pathak Shamabesh Publishing House in 2013.



Shahidul Zahir, 1953-2008, a prolific Bangladeshi short story writer and novelist, lived in Old Dhaka for most of his life, and used it as a backdrop in most of his stories. Known in Bangladesh for the use of magical realism in his plots, he introduces his readers to a world of human-animal relationships, rituals, myths, superstitions, and traditions. His major works include the short story collections Parapar (1985), Dumur-kheko Manush O Onyanya Golp (2000), and Dolu nodir Hawa O Onyanya Golp (2004), and the novels Jibon O Rajnaitik Bastobota (1988), Mukher dike dekhi (2006) and Abu Ibrahimer Mrityu (2009). This article from The Dhaka Tribune remembers the author and his work.